র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে মাদক, অস্ত্র, জঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা,বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা, পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বাউল মডেলসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিনের পলাতক আসামিদের প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত রাতে র্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকা হতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক যুদ্ধাপরাধী মোঃ মোন্তাজ আলী ব্যাপারী মমতাজ (৭৬)কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
দুপুরে র্যাব-৩ এর প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিক এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন আসামি মমতাজ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের একই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪ টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ১৯৭১ সালে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ঘোষিত তালিকা মোতাবেক ধৃত আসামি মমতাজ জামায়াতে ইসলামীর গাইবান্ধা সদর এর সক্রিয় সদস্য ছিল। উক্ত মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামী আব্দুল জব্বার গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিল। জব্বারের সাথে যোগসাজসে ধৃত মমতাজ শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে অত্র এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাত।
১৯৭১ সালের পহেলা জুন সকাল ১০.ঘটিকার দিকে ধৃত মমতাজ, আব্দুল ওয়াহেদ, জাছিজার রহমান, আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়াসহ হেলাল পার্ক আর্মি ক্যাম্প হতে একদল পাক হানাদার ও রাজাকারের সমন্বয়ে ২০/২৫ জনের একটি দল গাইবান্ধা সদর থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পূর্ব পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হামলা চালায়। অম্বিকাচরণ সরকার এবং আব্দুর রউফ এর বাড়িতে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ধৃত মমতাজ এবং তার সহযোগী ওয়াহেদ, জাছিজারসহ অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সাথে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। একপর্যায়ে তারা অম্বিকাচরণকে ধরপাকড় করে মুখে, মাথায় এবং সারা গাঁয়ে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে।
আঘাতের ফলে অম্বিকাচরন মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকলে তারা তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে লুটপাটকৃত মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। এরপর রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সম্মিলিত হয়ে ধৃত মমতাজ এবং উক্ত মামলার অপর আসামিরা একই গ্রামের দিজেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। এছাড়াও ফুলকুমারী রাণী এবং সন্ধ্যা রাণীকে পাশবিক নির্যাতনপূর্বক জোড় করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায়। উক্ত ঘটনায় সেই বাড়ির মালিক দ্বিজেশচন্দ্র বাধাঁ দিতে আসলে তারা তাকে গাইবান্ধা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে এবং তার মৃতদেহ গুম করে দেয়। এছাড়াও তারা অত্র এলাকার অসংখ্য বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারগুলোকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করে।
গত ১৮ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখ সকাল ০৮০০ ঘটিকার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে ধৃত মমতাজ, রঞ্জু, জব্বার, জাছিজার ও ওয়াহেদ মিলে গাইবান্ধা সদরের নান্দিনা গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালায়। সেই হামলায় তারা ওই গ্রামের আবু বক্কর, তারা আকন্দ, আনছার আলী এবং নছিম উদ্দিন আকন্দকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আসামিদের নেতৃত্বে একই গ্রামের সামাদ মোল্লা, শাদা মিয়া, ফরস উদ্দিন ও সেকান্দার আলী মোল্লাকে বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি সেই দিনে ধৃত মমতাজের নেতৃত্বে তারা ৪০ টিরও অধিক বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে।
একই দিনে তারা ২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পাশের দৌলতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে লাল মিয়া বেপারী, আব্দুল বাকী, খলিলুল রহমান, দুলাল মিয়া, মহেশ চন্দ্র মন্ডল’কে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও গাইবান্ধা সদর এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি গ্রামে (নান্দিনা, মিরপুর, সাহারবাজার, কাশদহ, বিসিক শিল্প নগরী, ভবানীপুর ও চকগায়েশপুর) সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, ইসলাম উদ্দিন এবং নবীর হোসেনসহ মোট সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে।
তিনি আরো বলেন আব্দুর রউফ ২০০৯ সালে গাইবান্ধা অধস্তন আদালতে ধৃত আসামি মমতাজসহ ০৫ জনকে বাদী করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলে মমতাজসহ অন্যান্য আসামিরা ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামিনে থাকে। ২০১৬ সালে জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এবং পরবর্তী জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হলে তখন থেকে উক্ত আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর গভীর তদন্তে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমানিত হলে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক ৫ জন আসামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করা হয়।
মামলার রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় দুই আসামি (আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়া) মারা যায়। ইতোপূর্বে উক্ত মামলার পলাতক আসামি জাছিজার রহমান এবং আব্দুল ওয়াহেদ মন্ডল’কে র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটির সর্বশেষ পলাতক আসামি মোন্তাজ আলী ব্যাপারী মমতাজ’কে গতরাতে র্যাব-৩ কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য যে, মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন ২০১৬ সালে ধৃত মমতাজ তার নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকতে শুরু করে। সে মাঝে মাঝে গোপনে তার পরিবারের সাথে দেখা করত। ২০১৬ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন সে কখনই আদালতে হাজিরা দেয়নি।
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় ধৃত মমতাজ এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এর পরপরই মমতাজ তার নিজ বাড়ি ছেড়ে গাইবান্ধা সদরে তার জামাতার বাড়িতে আত্মগোপন করে। সেখান হতে প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে তার বড় ছেলে শফিকুল ইসলামের ভাড়া বাসায় আসা যাওয়া করত। তার ছেলের ভাড়া বাসাটি নিজ জেলা হতে দূরবর্তী হওয়ায় সেখানে বেশি নিরাপদ ভেবে পরবর্তীতে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের দিকে স্থায়ীভাবে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকায় ছেলের বাসায় বসবাস করতে থাকে। সেই বাসা হতেই গতরাতে র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার হয় এই যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।